মা,
কখন পড়ছিস, কিভাবে পড়ছিস, কোন অবস্থায় পড়ছিস আমি জানি না। আমি এও জানি না, যখন তুই এই চিঠি পড়ছিস, তখন আমি বেচে আছি কিনা! কিংবা বেচে থাকলেও তোর পাশে আছি কিনা। সবসময় একটা শংকা কাজ করে (বেচে না থাকলে করতো) আমার মনে, তোকে নিয়ে। তোর বয়সী মেয়েদের নিয়ে। তোর চাইতে ছোট বা তোর চাইতে বড় মেয়েদের নিয়ে। ভাবছিস কিসের শংকা? শংকা আছেরে মা, অনেক শংকা। ভাত-কাপড়ের শংকা, ভাল থাকার শংকা। প্রতিদিন এই নাগরিক জীবনের নানাবিদ কাজের মধ্যে অনেক ঝুট ঝামেলার মধ্যে অবিরাম বেচে থাকার আপ্রান চেষ্টা আমাদের। হুম, সন্ধ্যায় ঠিকমত বাসায় ফিরতে পারবি কিনা, থাকলেও সম্ভ্রম অক্ষত থাকবে কিনা! এইসব শংকা আমার সবসময়। তোর মা বেচে থাকলে এই শংকার জায়গা আমার তৈরি হতো না। কোন কিছু হলে কি বলতাম তাও জানি, বলেই ফেলতাম, “সারাদিন ঘরে থেকে কি কর? মেয়ের দিকে খেয়াল রাখতে পার না?” ব্যস এইটুকুই আমার দায়! পুরুষতো, পুরুষালী স্বভাব বের হবেই। কিন্তু এখন? এখন আমি শংকিত! সারাক্ষন শুধু ভয়ের মধ্যে থাকি। তুই ফ্রীজ থেকে চুপিচুপি ঠান্ডা পানি-অথবা আইসক্রীম খাচ্ছিস নাতো? কিংবা ধর বাথরুমে গিয়ে অযথাই পানি নাড়াচাড়া করে ঠান্ডা বাধাচ্ছিস নাতো? তোর জ্বর হয়নিতো? কিংবা দোকান চাচুর দোকানে গিয়ে সস্তা চকলেট বা প্রচুর প্রিজারভেটিব দেয়া, গায়ে ”১০০% প্রাকৃতিক” ল্যাবেল আটা জুস আমার অগোচরেই খাচ্ছিস নাতো?

এই দেখ কত ছোট ছোট শংকা আমার! তুই মেয়ে না হয়ে ছেলে হলেও আমার একই শংকা থাকতো। কিন্তু তোর শারিরিক গঠন আমাকে আরো বেশি শংকিত করে ফেলে। না এতে তোর দোষ নেই, কারন প্রকৃতির দেয়া অমূল্য রত্ন তুই, তোর শারিরিক গঠন তৈরি হয়েছে প্রকৃতিকে বাচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু, মারে এই মূল্যবোধহীন সমাজে তোকে আর তোর মতো অন্যসব নারীকেই পুরুষেরা তৈরি করে রেখেছে শুধু মাত্র ভোগ্যপন্য হিসেবে! একজন বাবা হিসেবে তোর কাছে খোলামেলা এইসব কথা লিখতে আমার খুব লজ্জা হচ্ছে। কিন্তু নিজের সাথে যুদ্ধ করে আমি লিখছি! উপায় নাই মা। কারন, তোর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়ার সুযোগ আমি আর নাও পেতে পারি। এই সমাজে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় সকালের আমি বিকেলে ফিরবো কিনা বলতে পারি না। মারে, আমার শংকার জায়গা এজন্য আরো বেশি। শংকিত হবো না কেন বল? এই সমাজে দেড় বছরের কন্যা শিশু ধর্ষিত হয়। ষাটর্উদ্ধ মহিলার শালীনতা হানি হয় খোদ মসজিদের ইমাম দ্বারা… কই যাব বল? আজকে তোকে চিঠি লিখার এইটা অন্যতম কারন।

এর আগে এক ভন্ড নারীদের তেতুলের সাথে তুলনা করেছিল, পেটের দায়ে গার্মেন্টে কাজ করতে আসা নারীরা নাকি জেনা করে টাকা উপার্জন করে। তাদের পড়াশুনার দরকার নাই। একজন সুস্থ্য মস্তিষ্কের পুরুষ এইভাবে উক্তি করতে পারে? এই পুরুষ হিসেবে আরেক পুরুষের এহেন কার্যকলাপে আমিই লজ্জিত হলাম। ঘটনার পর কয়েকদিন আমি খোদ তোর দাদীর দিকেই তাকাতে পারি নাই লজ্জায়, তোকে কোলে নিতেও আমার লজ্জা হতো। তোর মার মৃত্যুর পর তোকে পাশে নিয়ে ঘুমাতে আমার লজ্জা হয়। আরো বেশি অবাক হয়েছি শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে কিছু নারীই এই উক্তিটি সর্মথন দিয়েছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ এর চাইতে, নিজের হাতের তালুতে নিজের থুতু নিয়ে আবার চেটে খেয়ে নেয়াটা বেশি রুচিকর।

আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালেও নারীরা নির্যাতিত হয়েছেন, নারীদের সম্ভ্রমহানী হয়েছে। নির্বিচারে হত্যা করেছে পাকিস্তানী আর্মি, এই দেশেরই কিছু ধর্মীয় লেবাসধারীর সহযোগীতায়। আমিসহ আরো অনেকে বিশেষকরে আমাদের সময়কার তরুন প্রজন্ম তার বিচার চাওয়াতে নষ্ট আর নাস্তিক তকমা দিয়েছেন বিশেষ কারেন ক্ষমতাপ্রাপ্ত আরেক নারী! ইতিহাস বলে, যিনি নিজেও একজন বিরাঙ্গনা ছিঃ ছিঃ ছিঃ আমাদের মূল্যবোধের কত অবনতি দেখ। এরপরও আমরা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করি। আমার শংকা হবে না কেন বল?

একবার দিনাজপুরে ইয়াসমিন নামের এক মেয়েকে ধর্ষনেরপর হত্যা করে পুলিশ সদস্যরা। এরপর হতেই থাকলো, হচ্ছেই। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় এসিডে ঝলসে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে কত নারীর শরীর! কিছুদিন আগে মাত্র ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ভুল পথে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চলে আসে ছোট্ট একটি মেয়ে। সন্ধ্যা হয়ে আসায় রাস্তার পাশে বসে কাঁদছিল সে। নিরাপত্তার কথা ভেবে স্থানীয় লোকজন তাকে তুলে দেয় পুলিশের হেফাজতে। কিন্তু থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা পরের দিন আদালতে হাজির না করে তাকে তিন দিন থানায় আটকে রেখে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে। আমার শংকা হবে না কেন বল? কোথায় যাবো আমরা? কার কাছে নিরপত্তা চাইবো? কে দিবে নিরাপত্তা?

স্কুলে আসা যাওয়ার সময় অতপেতে থাকে ইভটিজাররা…. টিজিং এর শিকার হয়ে লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে কতশত মেয়ে তার ইয়াত্তা নেই। স্কুলেও শিক্ষক বেশে লুকিয়ে থাকে নরপশু পরমল-জয়ধরেরা। অফিসে কত নারীকে যৌন হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে তার হিসেব কে রাখে? বাসে-ট্রেনে-হাটে-স্কুলে-কলেজে-বাসায় কোথাও নারী নিরাপদ না।

আমার শংকার জায়গা এজন্য আরো বেড়ে যায়। আমি শংকিত হই! তোর সাথে এরকমটা ঘটবে না, কিভাবে বলি? এই আশংকা থেকে তোকে আমার এই খোলা চিঠি। আমার এই চিঠির জবাব তোকে দিতে হবে না। এই চিঠির জবাব তুই দিবি তোর কাজের মধ্য দিয়ে। এই পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ ভেঙ্গে ফেল মা। আস্তাকুড়ে ফেলে আয়। নারী আর পুরুষ সমান কর্মযোগে গড়ে তোল আগামীর শ্বাশত সুন্দর সমাজ। জানি বড় কঠিন, কিন্তু মা এটা তোকে করতেই হবে। সময়ের প্রয়োজন যুগপোযোগী যত কঠিন সিদ্ধান্তই নিতে হয়, নিবি। প্রয়োজনে নরপশুদের হত্যা করবি। নিজের আত্মরক্ষায় প্রয়োজনে হত্যা কর, প্রতিশোধ নে। কোন অবস্থাতেই আত্মহনন নয়। ইদুরের মত বেচে থাকার কোন মূল্য নাই। বাঘের মতো ক্ষীপ্রতা নিয়ে একদিন বেচে থাকার অনেক মূল্য।

ইতি তোর বাবা